নিচের কোনো একটি বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লেখো-
ক) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ;
খ) সুন্দরবনের জীববৈচিত্রা;
গ) যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদী;
ঘ) বাংলাদেশের গ্রাম;
৩) ইন্টারনেট ব্যবহারের ভালো-মন্দ দিক
তোমার লেখা প্রবন্ধ থেকে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে দেখো-
প্রবন্ধ কী
গদ্যভাষায় রচিত এক ধরনের সুবিন্যস্ত রচনার নাম প্রবন্ধ। প্রবন্ধের মধ্যে তথ্যের বিবরণ থাকে, আবার তথ্যের বিশ্লেষণও থাকে। প্রবন্ধ চিন্তাশীল রচনা বলে এতে আবেগের চেয়ে যুক্তির প্রাধান্য বেশি থাকে। গঠন অনুযায়ী প্রবন্ধ মূলত দুই ধরনের: বিবরণমূলক ও বিশ্লেষণমূলক। আবার, বিষয়ের কথা বিবেচনা করলে প্রবন্ধ অনেক রকমের হয়; যেমন-সাহিত্য বিষয়ক, ইতিহাস বিষয়ক, সংস্কৃতি বিষয়ক, সমাজ বিষয়ক, শিক্ষা বিষয়ক, রাজনীতি বিষয়ক, খেলাধুলা বিষয়ক ইত্যাদি। প্রবন্ধের শুরুতে বক্তব্যের সঙ্গে মিল রেখে প্রবন্ধের একটি শিরোনাম দিতে হয়। প্রবন্ধের প্রধান অংশ তিনটি-ভূমিকা, মূল আলোচনা ও উপসংহার।
ভূমিকা: ভূমিকা প্রবন্ধের প্রবেশক অংশ। এ অংশে মূল আলোচনার ইঙ্গিত থাকে। প্রবন্ধের শিরোনামের কোনো শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন হলে সেটি ভূমিকাতেই দিতে হয়। আলোচনা কীভাবে অগ্রসর হবে, তার ইঙ্গিতও থাকে ভূমিকায়।
মূল আলোচনা: মূল আলোচনা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত থাকতে পারে। কখনো কখনো ভাগগুলোকে পরিচ্ছেদ দিয়ে বিভাজন করা যায়। এসব ক্ষেত্রে পরিচ্ছেদগুলোর আলাদা শিরোনাম থাকতে পারে, যার নাম পরিচ্ছেদ শিরোনাম। গুরুত্বের ভিত্তিতে, যুক্তির ভিত্তিতে, কালের ক্রম অনুযায়ী পরিচ্ছেদগুলোকে পরপর সাজিয়ে নিতে হয়।
এক অনুচ্ছেদ থেকে অন্য অনুচ্ছেদে উত্তরণের সময়ে সঙ্গতি থাকছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। প্রবন্ধের মধ্যে একই কথা বার বার উল্লেখ করা ঠিক নয়। এক অংশের বক্তব্য অন্য অংশের বক্তব্যের সঙ্গে কোনো রকম বিরোধ সৃষ্টি করছে কি না, সেটি খেয়াল রাখতে হয়।
মূল অংশের মধ্যে অনেক সময়ে সারণি বা নকশা ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এগুলো কখনো বক্তব্যকে শক্তিশালী করে, আবার কখনো বক্তব্যকে অস্পষ্ট করে। সেটি বিবেচনায় রেখে সারণি বা নকশা ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপসংহার প্রবন্ধের শেষ অংশকে উপসংহার বলে। এটি প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ নয়; ফলে পুরো প্রবন্ধের বক্তব্যকে এখানে নতুন করে বলার দরকার নেই। এমনকি, উপসংহারে নতুন প্রসঙ্গের অবতারণাও করা যায় না। উপসংহারে প্রবন্ধ-লেখকের নিজের মতামত তুলে ধরা জরুরি। এই মতামতের মধ্যে আলোচ্য বিষয়ের উপযোগিতা নিয়ে কথা বলা যায়, কোনো সুপারিশ করা যায়, সিদ্ধান্ত বা ফলাফল উপস্থাপন করা যায়, সীমাবদ্ধতার কথা বলা যায়, সম্ভাবনার ইঙ্গিত তুলে ধরা যায়। উপসংহারে বলা যেতে পারে' বা 'সবশেষে বলা যায়'-এ ধরনের বাক্য উপসংহারে না থাকাই ভালো।
অনেক সময়ে প্রবন্ধে ভূমিকা, উপসংহার কিংবা মূল আলোচনার পরিচ্ছেদ-শিরোনাম আলাদা করে উল্লেখ করা হয় না। তবে প্রবন্ধের মধ্যে এগুলো ঠিকই বিদ্যমান থাকে।
আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) একজন প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'চৌচির', 'রাঙা প্রভাত', 'মাটির পৃথিবী', 'মানবতন্ত্র', 'একুশ মানে মাথা নত না করা', 'দুর্দিনের দিনলিপি' ইত্যাদি। নিচের প্রবন্ধটি লেখকের 'নির্বাচিত প্রবন্ধ' বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
সভ্যতার সংকট
আবুল ফজল
মানুষের একটা বড়ো পরিচয়, সে ভাবতে পারে। করতে পারে যে কোনো চিন্তা। যে চিন্তা ও ভাব মানুষকে সাহায্য করে মানুষ হতে। পশুপাখিকে পশুপাখি হতে ভাবতে হয় না-পারেও না ওরা ভাবতে বা চিন্তা করতে। সে বালাই ওদের নেই-যেটুকু পারে তার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ-বাঁচা ও প্রজননের মধ্যে তা সীমিত। সভা- অসভ্যের পার্থক্যও এ ধরনের। যারা যত বেশি চিন্তাশীল, সভ্যতার পথে তারাই তত বেশি অগ্রসর। আর চিন্তার ক্ষেত্রে যারা পেছনে পড়ে আছে, সভ্যতার পথে তারাই তত বেশি অনগ্রসর। আর চিন্তার ক্ষেত্রে যারা পেছনে পড়ে আছে, সভ্যতারও পেছনের সারিতেই তাদের স্থান। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি, দেশ-সবের বেলায় এ সত্যের তারতম্য নেই। মোটকথা, সভ্যতার প্রথম সোপানই হলো চিন্তা-চিন্তার অভ্যাস তথা বুদ্ধির চর্চা।
শুধু রসের দিক বা সৌন্দর্য সাধনার দিক যেমন সাহিত্যের সব কিছু নয়, তেমনি সভ্যতার বেলায়ও শুধু আনন্দ ও আরাম-আয়েসের উপকরণ-বাহুল্য কখনো সভ্যতার সব কিছু নয়। এমনকি সভ্যতার বড়ো অংশ নয় এসব। সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্ক রয়েছে মানুষের হৃদয়, মন ও চরিত্রের আর মানসিক উৎকর্ষের। মাত্রাধিক আরাম ও উপকরণ-বাহুল্য এসবকে দৃঢ় ও পুষ্ট করে তোলার পরিবর্তে বরং করে তোলে আরো শিথিল ও দুর্বল। আজ সভ্যতা মানে উপকরণ-প্রাচুর্য ও গতি। দ্রুতগামী বায়ুযানে কে কত হাজার মাইল ঘুরে এলো, কার আগে কে পৃথিবী চক্কর দিতে পারল-এ হলো এখন সভ্যতার মাপকাঠি। মানুষ ভাববে কখন, চিন্তা করবে কখন-জীবনের গভীরত্ব উপলব্ধির অবসর কোথায় আজ মানুষের?
প্রাচীন জীবন-দর্শন থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন, অথচ নতুন কোনো জীবন-দর্শনও গড়ে ওঠেনি। সব জীবন-দর্শনের গোড়া হলো চিন্তা-চিন্তার চর্চা। মানুষের জীবন থেকে আজ চিন্তার ক্ষেত্র অপসারিত-ফলে কোনো জীবন- দর্শনই আজ মানুষের সামনে নেই। সিনেমা, টেলিভিশন, রেডিও যেখানে মানুষের অবসর সময়টুকুর অধিকাংশ গ্রাস করে চলেছে, সেখানে চিন্তা চর্চার সময় কোথায়? ফলে আজ ধীরে ধীরে, নিজের অজ্ঞাতেই মানুষ যন্ত্রের শামিল হয়ে পড়েছে। মানুষের এখন যা নিয়ে অধিকাংশ সময় কাটে তা হচ্ছে যন্ত্র ও যান্ত্রিকতা। হৃদয়, মন, আবেগ, অনুভূতি সবই যন্ত্রের সুরে বাঁধা। আমি এমন পরিবারও দেখেছি যাঁরা এক ঘুমের সময় ছাড়া সব সময়ে নিজেদের রেডিও যন্ত্রটা খুলে রাখেন। নিস্তব্ধতার যে একটি অনির্বচনীয় শান্তি আছে এঁরা তার স্বাদ থেকে তো বঞ্চিত থাকেনই তদুপরি নিজেদের সুকুমার বৃত্তির ওপর কী যে নিষ্করুণ উৎপীড়ন এঁরা করছেন তাও বুঝতে পারেন না। অতি-যান্ত্রিকতার এ হচ্ছে পরিণাম। এসব মানুষের জীবনের মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভাবার বা অন্ন-চিন্তার অতিরিক্ত অন্য চিন্তা করার অবসর কোথায়? ফলে জীবন-দর্শন সম্বন্ধে এঁদের কোনো সন্দেহ থাকার কথাই নয়। রেডিও বাজানোকেই এঁরা মনে করেন চরম সংস্কৃতিচর্চা। চিন্তার প্রতি এই বিরাগ ও বিতৃষ্ণা মানব সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধির রূপ নিয়েছে আজ। আজ সভ্যতার যে সংকট তা হচ্ছে এই চিন্তাহীনতার সংকট; আণবিক বোমা বা আনুষঙ্গিক অন্যান্য মারণাস্ত্র নয়। তথাকথিত 'শীতলযুদ্ধ' ও এই চিন্তাহীনতার ফল। জীবনের মূল্য ও মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভাবতে ভুলে গিয়েছে আজ মানুষ। ফলে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই প্রায় হয়ে পড়েছে নীতিভ্রষ্ট। বুদ্ধি ও চিন্তার চর্চা মানুষকে যুক্তিবাদী ও বিবেকী করে তোলে। যে কোনো অবস্থায় বিবেকী মানুষ হিরোশিমা ও নাগাসাকি ঘটাতে পারে না। বিবেকহীন সভ্যতা মানুষকে বর্বরতার কোন চরম সীমায় নিয়ে গেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এই দুটি নাম তার অক্ষর স্বাক্ষর। নীতি ও জীবনের মূল্যবোধ ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতা ও তার প্রগতি মানুষকে কোনো লক্ষ্যেই নিয়ে যায় না।
নীতি ও জীবনের মূল্য সম্বন্ধে অবিশ্বাসের চরম পরিচয় মেলে যুদ্ধ ও তথাকথিত জাতীয় সংকটের সময়ে। তখন নীতি, ন্যায়, সত্য ও মূল্যবোধ সবই হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া হয়। যান্ত্রিক সভ্যতার চরম কাম্য যে কোনো মূল্যে জয় অর্জন। হিরোশিমা ও নাগাসাকি এই আদর্শেরই দুই বলি। চিন্তা করার বা চিন্তা করতে না দেওয়ার ফলে তাবৎ সভ্য দেশের অধিকাংশ লোক 'কর্তার ইচ্ছায় কর্ম' বলে একে মেনে নিয়েছেন।
নিজে চিন্তা না করার সবচেয়ে বড়ো কুফল হচ্ছে সত্য-মিথ্যা যে কোনো কথা ও প্রচারণাকে বিশ্বাস করে বসা। আর যান্ত্রিক সুখ-সুবিধায় অভ্যন্ত মানুষও মাথা খাটানোর কষ্ট স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। তাই আজ সর্বত্র চিন্তার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে বন্ধ্যত্ব, মানুষ হয়ে পড়েছে গতানুগতিক, হারিয়ে বসেছে সত্যের প্রতি সব রকম অনুরাগ। মানুষের জীবনে সত্য ও ন্যায়ের-যে কোনো মূল্য আছে মানুষের মন থেকে সে বোধও আজ নিশ্চিহ্ন। য জগতের যেমন দিনে দিনে, ঘন্টায় ঘণ্টায় বদল হচ্ছে- মানুষের মত, বিশ্বাস আর ধারণাও তেমনি দিনে দিনে ও ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাল্টাচ্ছে। কোনো মত বিশ্বাসই আজ মানুষের মনে দানা বাঁধতে পারছে না। আজ সভ্যতার এই এক শোচনীয় দশা। এ অবস্থায় কোনো বড়ো ও উচ্চ জীবনদর্শন আশা করাই যায় না। আশা করা যায় না কোনো মহৎ শিল্প-সাহিত্যও। রম্য রচনার সংখ্যা বৃদ্ধির এও এক বড়ো কারণ। বিগত সভ্যতা, যা মহৎ শিল্প-সাহিত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, এমনকি রেনেসাঁস ও এনসাইক্লোপিডিস্টদের যুগের দিকে তাকালেও আমরা বুঝতে পারব, মত-বিশ্বাস-আদর্শ-নিষ্ঠা, যা চিন্তা চর্চার ফল-সভ্যতার স্থিতি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য কতখানি আবশ্যক। আধুনিক সভ্যতার পায়ের তলায় এই অত্যাবশ্যক শর্তগুলি অনুপস্থিত। ফলে আজ সভ্যতার ত্রিশঙ্কু দশা।
বর্তমান সভ্যতা কোনো গভীর ভাব ও চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় বলে ক্রমবর্ধমান এত উন্নতি সত্ত্বেও পদে পদে ট্রাজিক পরিণতির হাত থেকে তা রেহাই পাচ্ছে না। আজ এই মহাসংকটের দিনে বাঁচতে হলে মানব সভ্যতাকে একটা নীতি ও সত্যের ওপর দাঁড় করাতে হবে। আর তা করাতে হলে মানুষকে ভাবতে হবে, করতে হবে চিন্তা ও যুক্তির চর্চা, হতে হবে বিবেকী।
আরও দেখুন...